গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার জৈনাবাজার আবদার এলাকায় মা ও তিন সন্তানকে গলা কেটে হত্যার ঘটনায় এক কিশোরকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
বৃহস্পতিবার বিকেলে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার জৈনাবাজার এলাকার একটি বাড়ি থেকে মা ও তিন সন্তানের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহতরা হলেন, আবদার এলাকার প্রবাসী রেদোয়ান হোসেন কাজলের স্ত্রী ইন্দোনেশিয়ান নাগরিক স্মৃতি আক্তার ফাতেমা (৪৫), তার বড় মেয়ে সাবরিনা সুলতানা নূরা (১৬) , ছোট মেয়ে হাওরিন হাওয়া (১২) ও ছেলে ফাদিল (৮)।
এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে রবিবার রাতে পারভেজকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে সোমবার বিকেলে গাজীপুরে পিবিআইয়ের কার্যালয়ে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান পিবিআই গাজীপুর ইউনিট ইনচার্জ নাসির আহমেদ শিকদার।
তিনি জানান, গ্রেপ্তার পারভেজ (১৭) আবদার গ্রামের কাজিম উদ্দিনের ছেলে। গ্রেপ্তারের পর পারভেজের ঘর থেকে তার দেখানো মতে রক্তমাখা কাপড় ও মাটির নিচে চাপা দেওয়া অবস্থায় মোবাইল ফোন উদ্ধার এবং একটি পায়জামার ভেতর থেকে তিনটি গলার চেইন, ফাতেমার কানের দুলসহ কিছু স্বর্ণালংকার উদ্ধার করা হয়।
হত্যার ঘটনা ওই কিশোর একাই ঘটিয়েছে বলে পিবিআই জিজ্ঞাসাবাদে জানায়।
আবদার এলাকার একই পরিবারের চারজনকে হত্যার আগে ২০১৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি নীলিমা নামে সাত বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের পর মাথায় আঘাত ও শ্বাসরোধ পারভেজ হত্যা করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, এ ঘটনায় পারভেজের বিরুদ্ধে মামলাও হয়। বয়স বিবেচনায় হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে মুক্ত হয় পারভেজ। জামিনের মুক্ত হওয়ার পর শিশু নীলিমার পরিবারকে মামলা প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্য বিভিন্ন ভয়ভীতি ও হুমকি দিতে থাকে পারভেজ। মামলা প্রত্যাহার না করা হলে তাদের মারপিট করে এলাকা ছাড়া করবে বলেও জানায় পারভেজ ও তার পরিবারের সদস্যরা।
এ বিষয়ে ২০১৮ সালে ২৮ আগস্ট নিরাপত্তা চেয়ে পারভেজ, তার বাবা কাজিম উদ্দিন, মা মোছা. কামরুন্নাহার ও আবুল কালামের নাম উল্লেখ করে শ্রীপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন শিশু নীলিমার বাবা।
জানা গেছে, আবদার এলাকার প্রবাসী রেদোয়ান হোসেন কাজলের স্ত্রী ও তিন সন্তানকে হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার পারভেজ এলাকায় বখাটে হিসেবে পরিচিত। মাদকসেবন থেকে শুরু করে বেচাকেনার সঙ্গেও তার সম্পর্ক রয়েছে।
মাদক সম্পৃক্ততা ও বখাটে আচরণের কারণে স্থানীয় লোকজন তাকে এড়িয়ে চলত বলে জানান ওই এলাকার বাসিন্দা হারুন অর রশিদ। পরিবারের সদস্যরা অনেক চেষ্টা করেও তাকে ভালো পথে আনতে পারেননি বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, অবশেষে ফোর মার্ডার মামলায় পিবিআইয়ের হাতে ধরা পড়ল পারভেজ।
পারভেজের চাচা আসাম উদ্দিন বলেন, পারভেজ অনেক আগে থেকেই মাদক সেবন ও বিক্রির সঙ্গে যুক্ত। টাকার জোরে একটি মার্ডার মামলা থেকে পারভেজ পার পেয়ে যায়। তখন যদি সে ওই মামলায় পার না পেত তাহলে এমন লোমহর্ষক হত্যা ঘটানোর সাহস পেত না।
প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান হয়, মামলার শুরুতেই ভিন্ন আঙ্গিকে তদন্ত শুরু করে পিবিআই। আগের বিভিন্ন ঘটনা পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা, এলাকার বখাটে, মাদক সেবনকারী ও ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন জনের তথ্য সংগ্রহ করে পিবিআই। এসব তথ্য পর্যালোচনা করে রবিবার রাতে পারভেজকে আবদার এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে সে হত্যার কথা স্বীকার করে। পরে তাকে নিয়ে অভিযানে বের হয় পিবিআই। এ সময় পারভেজের ঘর থেকে তার দেখানো রক্তমাখা কাপড় ও মাটির নিচে চাপা দেওয়া অবস্থায় মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।
পিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে পারভেজ আরো জানায়, ২৩ এপ্রিল রাত সাড়ে ১২টায় প্রবাসী কাজলের স্ত্রী ও বড় মেয়ের স্মার্টফোন চুরির উদ্দেশ্যে পার্শ্ববর্তী বাবুলের বাড়ির পেছন দিক দিয়ে কাজলের বাড়ির দেয়ালে বেয়ে ছাদে উঠে। ব্লেড দিয়ে ছাদে কাপড় টানানোর রশি কেটে ছাদের গ্রিলের সঙ্গে বেঁধে রশি বেয়ে একটু নিচেই দোতলার বাথরুমের ফাঁকা জায়গা দিয়ে ভেতরে ঢুকে সে। সে ওয়াশিং মেশিনের ওপর পা দিয়ে নিচে নেমে সাবরিনা সুলতানা নূরা ও হাওরিনের রুমে প্রবেশ করে খাটের নিচে লুকিয়ে থাকে। নূরার তখন কানে হেডফোন ছিল ও ছোটে বোনে হাওরিন ঘুমিয়ে ছিল। অনুমান এ ঘণ্টা পর সবাই ঘুমিয়েছে ধারণা করে নিচ তলায় নেমে রান্না ঘর থেকে ধারালো বটি নিয়ে দোতলায় উঠে মোবাইল নেয়ার জন্য নূরার মার কক্ষের দরজার লক খোলার চেষ্টা করলে এ শব্দে নূরার মা জেগে ওঠে বাথরুমে ও আশপাশ কেউ আছে কিনা খোঁজ করেন।
পিবিআই জানায়, এ সময় নূরার মা (কাজলের স্ত্রী) ফাতিমা পারভেজকে দেখে চিনে ফেললে চিৎকার দেন। তখন সে তার হাতে থাকা বটি দিয়ে কাজলের স্ত্রীকে মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাতাড়ি কোপায়। নূরার মা অজ্ঞান হয়ে ফ্লোরে পড়ে যান। নূরা শব্দ পেয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলে তাকেও বটি দিয়ে মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। পরে নূরার ছোট ভাই ফাদিল জেগে উঠলে তার মাথায় কোপ মারে। সে ফ্লোরে পড়ে গেলে প্রথমে তাকে জবাই করে খাটের নিচে রাখে তারপর হাওরিন ঘুম থেকে জেগে উঠে চিৎকার দিলে তাকেও কোপায়। পরবর্তীতে সে নূরাকে ধর্ষণ করে। নূরার মাকে ওড়না দিয়ে হাত পা বেঁধে অর্ধমৃত হাওরিনকেও ধর্ষণ করে এবং মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য সবাইকে গলা কেটে হত্যা করে। এরপর নূরার মার গলায় একটি স্থানের চেইন, কানের দুল ও নাকফুল খুলে নেয় এবং হাওরিনের কান থেকে দুটি স্বর্ণের রিং খুলে নেয়। পরবর্তীতে আলমিরা খুলে দুটি স্বর্ণের চেইন, একটি আংটি, ১টি লাল রঙের ছোট ডায়েরি, নূরার মায়ের রুম থেকে দুটি স্মার্টফোন নেয়। মোবাইল ও স্বর্ণালংকার তার পরিহিত পায়জামার পকেটে রাখে। এরপর সে হাত মুখ ধুয়ে ফেলে পেছনের গেট খুলে নিজ বাড়ি চলে যায়।