বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের ওয়েবসাইড থেকে সংগৃহীতঃ
সরদার মাহামুদ হাসান রুবেলঃ
সকলের আদর, ভালবাসা, অপার সম্ভাবনা ও সোনালী ভবিষ্যৎ নিয়ে বেড়ে ওঠা এক প্রাণচঞ্চল শিশু -জন্মগত সচেতনতা দেখা গিয়েছিলো শেখ রাসেলের মধ্যে।
এই অপ্রস্ফুটিত ফুলের কুঁড়ির মত এই শিশুটির কথা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইটিতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘চলাফেরায় ও বেশ সাবধানী কিন্তু সাহসী ছিল, সহসা কোনও কিছুতে ভয় পেতো না। কালো কালো বড় বড় পিপড়া দেখলে ধরতে যেত। একদিন একটা ওল্লা (বড় কালো পিপড়া) ধরে ফেলল, আর সাথে সাথে পিঁপড়াটা ওর হাতে কামড়ে দিল। ডান হাতের ছোট্ট আঙুল কেটে রক্ত বের হলো। সাথে সাথে ওষুধ দেওয়া হলো। আঙুলটা ফুলে গেছে। তারপর থেকে আর ও ওল্লা ধরতে যেত না। তবে ওই পিঁপড়ার একটা নাম নিজেই দিয়ে দিলো। কামড় খাওয়ার পর থেকেই কালো বড় পিঁপড়া দেখলে বলতো ‘ভুট্টো’।’ কিভাবে এই নাম শিখলো শিশু রাসেল? আমার মনে হয় জন্মগত ভাবেই রাজনীতি সচেতনও হয়েছিল ছোট্ট রাসেল।
রাসেলের বেড়ে ওঠার স্মৃতি হাতড়ে প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, ‘…রাসেলের সবকিছুতেই যেন ছিল ব্যতিক্রম। ও যে অত্যন্ত মেধাবী তার প্রমাণ অনেকভাবেই আমরা পেয়েছি। আমাকে হাসুপা বলে ডাকতো। কামাল ও জামালকে ভাই বলতো আর রেহানাকে আপু। কামাল ও জামালের নাম কখনও বলতো না। আমরা নাম বলা শেখাতে অনেক চেষ্টা করতাম। কিন্তু ও মিস্টি হেসে মাথা নেড়ে বলতো ভাই। দিনের পর দিন আমরা যখন চেষ্টা করে যাচ্ছি, একদিন ও হঠাৎ করে বলেই ফেলল, ‘কামমাল’, ‘জামমাল’।’
রাসেলের কোমলমতি মনের উদাহরণ আনতে গিয়ে এই বইয়েই আরেকটি ঘটনারও উল্লেখ করেন তার প্রিয় হাসুপা। তিনি লিখেছেন, ‘মা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন। রাসেলকে কোলে নিয়ে নীচে যেতেন এবং নিজের হাতে খাবার দিতেন কবুতরদের। হাঁটতে শেখার পর থেকেই রাসেল কবুতরের পেছনে ছুটতো, নিজ হাতে ওদের খাবার দিত। আমাদের গ্রামের বাড়িতেও কবুতর ছিল। কবুতরের মাংস সবাই খেত। বিশেষ করে বর্ষাকালে যখন অধিকাংশ জায়গা পানিতে ডুবে যেত, তখন তরিতরকারি ও মাছের বেশ অভাব দেখা দিত। তখন প্রায়ই কবুতর খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। তাছাড়া কারও অসুখ হলে কবুতরের মাংসের ঝোল খাওয়ানো হতো।… রাসেলকে কবুতরের মাংস দেওয়া হলে খেত না।ওকে ওই মাংস খাওয়াতে আমরা অনেকভাবে চেষ্টা করেছি। ওর মুখের কাছে নিয়ে গেছি, মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে…ওই বয়সে ও কী করে বুঝতে পারতো যে, ওকে পালিত কবুতরের মাংস দেওয়া হয়েছে!’
শিক্ষাজীবনের কথা বলতে গিয়ে স্মৃতি কথায় তিনি লিখছেন, ‘…স্বাধীনতার পর এক ভদ্রমহিলাকে রাসেলের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হল। রাসেলকে পড়ানো খুব সহজ কাজ ছিল না। শিক্ষককে ওর কথাই শুনতে হতো। প্রতিদিন শিক্ষয়িত্রীকে দুটো করে মিষ্টি খেতে হবে। আর শিক্ষয়িত্রী এ মিষ্টি না খেলে ও পড়তে বসবে না। কাজেই শিক্ষিকাকে খেতেই হেতো। তাছাড়া সবসময় ওর লক্ষ্য থাকত শিক্ষিকার যেন কোনও অসুবিধা না হয়। মানুষকে আপ্যায়ন করতে রাসেল খুবই পছন্দ করতো।’
রাসেলের নামকরণ নিয়ে এই বইয়েই শেখ হাসিনা বলছেন, ‘অনেক বছর পর একটা ছোট্ট বাচ্চা আমাদের বাসায় ঘর আলো করে এসেছে, আনন্দের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে।আব্বা বাট্রান্ড রাসেলের খুব ভক্ত ছিলেন, রাসেলের বই পড়ে মাকে বাংলায় ব্যাখ্যা করে শোনাতেন। মা রাসেলের ফিলোসফি শুনে শুনে এত ভক্ত হয়ে যান যে, নিজের ছোট সন্তানের নাম রাসেল রাখলেন’।
বার্ট্রান্ড রাসেল শুধু একজন দার্শনিকই ছিলেন না, বিজ্ঞানীও ছিলেন। পারমাণবিক যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের একজন বড় মাপের বিশ্বনেতাও। তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ এড়ানোর জন্য শান্তি রক্ষার জন্যে বার্ট্রান্ড রাসেল গঠন করেছিলেন ‘কমিটি অব হানড্রেড’। মানুষের বসবাস যাতে সুন্দর ও শান্তিময় হয়, সেই লক্ষ্যে কাজ করেছেন বার্ট্রান্ড।
প্রধানমন্ত্রী ভাই হারানোর যন্ত্রনা থেকে লিখেছেন, হয়তো তার সাথে জার্মানী নিয়ে যেতে পারলে ছোট ভাইটি বেঁচে যেত ঘাতকের বুলেটের হাত থেকে। তিনি বলছেন, ‘৩০ জুলাই (১৯৭৫) আমি জার্মানিতে স্বামীর কর্মস্থলে চলে যাই। রাসেল খুব মন খারাপ করেছিল। কারণ জয়ের সাথে একসাথে খেলতো।আমি জার্মানি যাবার সময় রেহানাকে আমার সাথে নিয়ে যাই। রাসেলকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ওর হঠাৎ জন্ডিস হয়, শরীর খারাপ হয়ে পড়ে। সে কারণে মা ওকে আর আমাদের সাথে যেতে দেননি। রাসেলকে যদি সেদিন আমাদের সাথে নিয়ে যেতে পারতাম, তাহলে ওকে চিরতরে হারাতে হতো না।’
২৭ ডিসেম্বর, ২০১৭ সেনাবাহিনীর এক অনুষ্ঠানে ছোট ভাই শেখ রাসেল সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘রাসেলের লক্ষ্য ছিল সে বড় হয়ে সেনাবাহিনীর সদস্য হবে।’ চট্টগ্রামে বাংলাদেশ মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে নতুন কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে প্রধান অতিথির ভাষণে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। তিনি শিশু রাসেল সম্পর্কে আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু দরিদ্র মানুষের সঙ্গে নিজের খাবার ভাগ করে খেতেন। তিনি সব সময় তা করতেন। ঠিক সেই গুণটি রাসেলের মধ্যেও ছিল। গ্রামে গেলে দরিদ্র শিশুদের যে কিছু দিতে হবে তা সে চিন্তা করতো। রাসেলের খুব শখ ছিল বড় হয়ে সে আর্মি অফিসার হবে। সে কাঠের বন্দুক বানাতো। সেটা নিয়ে খেলা করতো।’
এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করে শেখ রাসেল কি হতে চায়? উত্তরে তিনিও বলেছিলেন, রাসেল মুক্তিযোদ্ধাদের খুব ভালোবাসে। এই কারনেই সে সেনাবাহিনীতে যুক্ত হতে চায়।
১৮ অক্টোবর ২০১৯ শুক্রবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে অশ্রুসিক্ত হয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আজকে শেখ রাসেল বেঁচে থাকলে হয়তো দেশের জন্য অনেক কিছু করত। মাঝে মাঝে মনে হয় ৫৪ বছর বয়সে কেমন হতো দেখতে তাকে? বলতে বলতে অশ্রুসিক্ত চোখে থেমে যান প্রধানমন্ত্রী।
শিশু রাসেলের জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে বাবা মুজিবকে ছাড়া। কারণ, বাবা মুজিব রাজনৈতিক বন্দি হয়ে কারাগারে ছিলেন দিনের পর দিন। আর চোখের সামনে বাবাকে দেখতে না পেয়ে মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে একপর্যায় ‘আব্বা’ বলেই সম্বোধন করতে লাগলেন। এই বিষয়ে শেখ হাসিনা বক্তৃতায় বলেন, ‘যখন সে আব্বা বলে ডাকত তখন মা বলতো, আমি তোমার আব্বা। আমাকেই আব্বা ডাকো। সেই জন্যই সে জেলখানায় গিয়ে আব্বাকেও আব্বা বলে ডাকতো, আম্মাকেও আব্বা বলে ডাকতো’।
‘কারাগারের রোজনামচা’য় শেখ রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, আব্বা বাড়ি চলো। ’ কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো। ’ ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলে-মেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’
ক্ষমতার লোভ মানুষকে কতটা অন্ধ করে দেয় তার প্রমাণ এ হত্যাকাণ্ড। আর সে সাথে এটাও পরিস্কার হয়ে যায় ক্ষমতার কাছে মানবীয় যে কোন সম্পর্ক এভাবেই হেয় হয়ে যায়। ঘাতক দল বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কাউকে মার্জনা করেনি, বিবেচনা করেনি কারো বয়স। আজ যারা বিচারহীনতার কথা বলে, যারা আইনের শাসন নিয়ে কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করে তারা কিন্তু রাসেল হত্যার বিচার বন্ধের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করেননি। বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারকে হত্যার পর অপরাধীদের দায়মুক্তি দেয়ার যে অপসংস্কৃতি দেশে চালু হয়েছিল তা থেকে বেরিয়ে আসার ধারা শুরু হয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। শেখ রাসেলের জন্মদিনে আমাদের অঙ্গীকার হোক, আর অসহিষ্ণুতা নয়, আর অপরাধীদের প্রশ্রয় বা দায়মুক্তি নয়। বাংলাদেশ হোক সব শিশুর, সব মানুষের নিরাপদ বাসভূমি।
লেখকঃ আহবায়ক, ঢাকা মহানগর বঙ্গবন্ধু পরিষদ