করোনা প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ওষুধের দাম লাগামহীন। কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে ইচ্ছামতো দাম হাঁকছেন দোকানিরা। অ্যান্টিবায়োটিক ও সাধারণ অন্যান্য ওষুধ বিক্রি হচ্ছে দ্বিগুণ-চারগুণ দামে। এ ছাড়া করোনাভাইরাসের প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বহুলপ্রচারিত কয়েকটি ওষুধের দাম নেওয়া হচ্ছে আকাশছোঁয়া। পাড়া-মহল্লার দোকানগুলোতে ওষুধের দামের তারতম্য সবচেয়ে বেশি। অবশ্য ওষুধ কোম্পানিগুলোও পরিবহন সংকট ও কাঁচামাল সংকটের কারণ দেখিয়ে বাড়িয়ে দিয়েছে বেশ কিছু অতিপ্রয়োজনীয় ওষুধের দাম। দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার অভিযানের পরও থামানো যাচ্ছে না ব্যবসায়ীদের এসব কারসাজি।
জানা যায়, বাড়তি মুনাফার লোভে করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দ্বিগুণ তিনগুণ দামে বিক্রি করছে ফার্মেসিগুলো। ৭৫০ টাকার আইভেরা ৬ এমজি ট্যাবলেট ২৪০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। ৫০ টাকার স্ক্যাবো ৬ এমজি ট্যাবলেট বিক্রি করছে ৮০০ টাকা পর্যন্ত। ২৫ টাকার জিংক ট্যাবলেট ৫০ টাকা, ২০ টাকার সিভিট ট্যাবলেট ৫০ টাকা, ৩৬০ টাকার রিকোনিল ২০০ এমজি ৬০০ টাকা, ৪৮০ টাকার মোনাস ১০ এমজি ট্যাবলেট ১০০০ টাকা, ৩১৫ টাকার অ্যাজিথ্রোসিন ৫০০ এমজি ট্যাবলেট ৬০০ টাকা বিক্রি করতে দেখা গেছে। ফার্মেসি মালিকদের অভিযোগ, তারা ওষুধের সরবরাহই পাচ্ছেন কম। বিক্রয় প্রতিনিধিরাই বেশি দাম নিচ্ছেন দোকানিদের কাছ থেকে। দেখা যায়, প্যারাসিটামল, নাপা, নাপা এক্সট্রা- ৫০০ এমজির এক পাতা যেটা আগে ছিল ৮ টাকা এখন বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা। ফেক্সোফেনাডিল গ্রুপের আগের দাম ৭৫ টাকা হলেও এখন নেওয়া হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকা। মনটিন ১০ এমজি একপাতা ২১০ থেকে নেওয়া হচ্ছে ২৩০ টাকা। মনাস ১০ এমজি প্রতি বক্স ৪১৫ টাকার জায়গায় বিক্রি হচ্ছে ৪৮০ টাকায়।
ঢাকার একটি চেইন ওষুধ বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ এক কর্মকর্তা জানান, বিশেষ করে নিউরোলজি, হার্ট, উচ্চ রক্তচাপ, অ্যান্টিবায়োটিক, ডায়াবেটিস এমনকি অস্ত্রোপচারের জন্য যেসব ওষুধের প্রয়োজন সেগুলোর দাম বেড়েছে সীমাহীন। তার মধ্যে রয়েছে বেক্সিমকোর অ্যাজমাসল (২০০)। আগে ওষুধটির দাম ছিল ১৯৫ টাকা, বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩০ টাকা। একইভাবে স্কয়ারের নিউরো-বি ১৮০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২৪০ টাকা, নিউরোক্যাল ১৫০ টাকা থেকে বেড়ে ২৪০ টাকা, রসুভাস (১০) ১৫০ টাকা থেকে ২৪০ টাকা, রসুভাস (৫) ৮০ থেকে ১০০ টাকা, টোসার ৪০ টাকা থেকে ৫০ টাকা, অ্যাডোভাস ৫৫ টাকা থেকে ৬৫ টাকা ইত্যাদি। এ ছাড়া কিছু ওষুধের দাম গায়ে যাই লেখা থাকুক না কেন মার্কেটে প্রচুর চাহিদা থাকার কারণে ওষুধ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে দাম নিচ্ছেন। এর মধ্যে রয়েছে আইভারমেকটিন ৬ এমজি এমআরপি মূল্য ১৫ টাকা লেখা থাকলেও নেওয়া হচ্ছে ১০০ টাকার বেশি। শ্বাসকষ্টের ওষুধ ডক্সিসাইক্লিন, ডক্সিক্যাপ প্রতি পাতার দাম ২০ টাকা হলেও নেওয়া হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকা।
ওষুধের পাশাপাশি করোনা প্রাদুর্ভাবের সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দেওয়া সার্জিক্যাল মাস্কসহ অন্যান্য মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, জীবাণুনাশক স্যাভলন, ডেটল, দেহে অক্সিজেনের মাত্রামাপক অক্সিমিটারের দাম হাঁকা হচ্ছে ইচ্ছামতো। একেক দোকানে একেক ধরনের দাম হাঁকা হচ্ছে। যার কাছে যেমন পাওয়া যাচ্ছে তেমন দাম নিচ্ছেন ওষুধ বিক্রেতারা। একই এলাকার একেক দোকানে একেক ধরনের দাম নেওয়া হচ্ছে। সকালে-বিকালেও একই ক্রেতার কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে দুই ধরনের দাম।
বগুড়া থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক আবদুর রহমান টুলু জানান, বগুড়ায় করোনাভাইরাস ও এর উপসর্গ থেকে সেরে উঠতে ইভেরা ও ডক্সিক্যাপ নামের ওষুধ বিক্রির ধুম পড়েছে। সাধারণ ক্রেতারা এই ওষুধ বেশি করে কিনে নেওয়ার ঘটনায় কিছু কিছু ওষুধের দোকানিরা ৬ থেকে ৮ টাকা দামের এই ট্যাবলেট এখন বিক্রি করছে প্রতিটি ২০ থেকে ২৫ টাকা করে। তিনগুণ দাম বাড়িয়ে বিক্রি করলেও প্রশাসন থেকে নেওয়া হয়নি কার্যকর কোনো পদক্ষেপ। বগুড়া শহরের ওষুধের মার্কেট হিসেবে পরিচিত খান মার্কেট, কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে প্রতিটি ইভেরা ৬ ও ১২ এমজির গায়ে ৬ টাকা এমআরপি দেওয়া আছে। কিন্তু বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকা করে। সমমূল্যের ডক্সিক্যাপ ট্যাবলেটও দাম বাড়িয়ে বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকা। শহরের কয়েকটি এলাকায় কে বা কারা বলেছে এই দুটি ওষুধ সেবন করলে করোনাভাইরাস থেকে সেরে উঠে এবং করোনাভাইরাসের কোনো উপসর্গও দেখা দেয় না। যে কারণে শহরে এই দুটি ওষুধ দাম বাড়িয়ে এখন ধুমছে বিক্রি হচ্ছে।
অন্যদিকে চট্টগ্রামে চলতি সপ্তাহে ফার্মেসিগুলোতে একাধিক দফায় চালানো অভিযানে উচ্চমূল্যে ওষুধ বিক্রি করতে দেখতে পেয়েছে র্যাব। ওষুধ অবৈধভাবে মজুদ করে নিয়মিত দামের চেয়ে ১০ গুণ বেশি দামে বিক্রি করার দায়ে তিন ফার্মেসি মালিককে আটকও করেছে। র্যাব-৭ এর সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) মো. মাহমুদুল হাসান মামুন জানান, আর সি ড্রাগ হাউসে আইভেরা ৬ মিলিগ্রাম নামের একটি ওষুধ ৬ প্যাকেট বিক্রি করছিল ২ হাজার ৪০০ টাকা করে, যার বাজারমূল্য ৭৫০ টাকা। গাউছিয়া ফার্মেসিতে স্ক্যাবো ৬ মিলিগ্রাম নামের একটি ওষুধ প্রতি পাতা বিক্রি করছিল ৫০০ টাকা, যার বাজারমূল্য ৫০ টাকা; জিংক ২০০ মিলিগ্রাম নামের একটি ওষুধ প্রতি পাতা বিক্রি করছিল ৫০ টাকা করে, যার বাজারমূল্য ২৫ টাকা এবং সিভিট ২৫০ মিলিগ্রাম নামের একটি ওষুধ প্রতি পাতা বিক্রি করছিল ৫০ টাকা, যার বাজারমূল্য ২০ টাকা। মেসার্স মাসুদা মেডিসিন শপে রিকোনিল ২০০ মিলিগ্রাম নামে একটি ওষুধ প্রতি প্যাকেট (৩ পাতা) বিক্রি করছিল ৬০০ টাকা, যার বাজারমূল্য ৩৬০ টাকা; মোনাস ১০ মিলিগ্রাম নামের ওষুধের প্রতি প্যাকেট (২ পাতা) বিক্রি করছিল ১ হাজার ৫০ টাকা, যার বাজারমূল্য ৪৮০ টাকা এবং অ্যাজিথ্রোসিন ৫০০ মিলিগ্রাম নামের একটি ওষুধের প্রতি প্যাকেট (৩ পাতা) বিক্রি করছিল ৬০০ টাকা, যার বাজারমূল্য ৩১৫ টাকা।
রাজশাহী থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক কাজী শাহেদ জানান, রাজশাহীতে বেড়েছে কাশি ও জ্বরের ব্যবহার্য ওষুধের দাম। জ¦রের ট্যাবলেট নাপা, এইস ও এইস-প্লাস প্রতি পাতায় আগের তুলনায় ৫ থেকে ১০ টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া কাশির সিরাপ এডোভাস ও তুশকার প্রতি ফাইলেও নেওয়া হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি। আর সিভিট মিলছে না ফার্মেসিগুলোতে। তবে এক টাকা পিসের সিভিট বেশি দাম দিলে পাওয়া যায়। রাজশাহীর লক্ষ্মীপুর এলাকার আলিফ-লাম ফার্মেসির মালিক আবু সাইদ জুয়েল জানান, সিভিট কোম্পানি থেকেই সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। নাপা ও এইস প্লাসের পাতার দাম ২ থেকে ৩ টাকা বেড়েছে। তবে অন্য ওষুধের দাম ঠিকই আছে। একমি ল্যাবরেটরি রাজশাহীর সিনিয়র এক্সিকিউটিভ আবদুল হালিম জানান, কোম্পানি ওষুধের দাম বাড়ায়নি। কোনো কোনো ফার্মেসি জ¦র ও কাশির ওষুধের দাম বেশি নিচ্ছে এটা তিনি শুনেছেন।