৬ জুলাই ২০২০
অন লাইন ডেস্কঃ চলে গেলেন “”জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার সারা দেহ খেও গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যে খানে’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় বাংলা গানের প্লে-ব্যাক সম্রাট অ্যান্ড্রু কিশোর।
দীর্ঘ ১০ মাস ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরে গেলেন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী অ্যান্ড্রু কিশোর। মৃত্যুর আগে অসুস্থাবস্থার শেষ দিকে তিনি বলেছিলেন, ঈশ্বর আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাও, বেশি কষ্ট দিও না।
অ্যান্ড্রু কিশোর সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে নিজ জন্মভূমি রাজশাহী মহানগরীর মহিষবাথান এলাকায় বোনের বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর।
এর আগে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চিকিৎসকেরা অপারগতা প্রকাশ করলে অ্যান্ড্রু কিশোর বলেন, দেশে ফিরেই তিনি মরতে চান। এর পরই তাকে সেখান থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। এরপর থেকেই তিনি রাজশাহীতে বোন ডা. শিখা বিশ্বাস ও ভগ্নিপতি প্যাট্রিক বিপুল বিশ্বাসের বাসাতে ছিলেন। বাড়ির সাথেই তাদের বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেলেন অ্যান্ড্রু কিশোর।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে অ্যান্ড্রু কিশোরের দেহে ক্যানসার ধরা পড়ে। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা করেও ক্যানসার নির্মূল হয়নি তার। চিকিৎসক হাল ছেড়ে দেওয়ায় গত ১১ জুন ক্যানসার নিয়েই ফিরতে হয়েছে দেশে। তারপর থেকেই ছিলেন রাজশাহীতে। রোববার শারীরিক অবস্থার ভীষণ অবনতি ঘটে।
অ্যান্ড্রু কিশোরের বোন জামাই প্যাট্টিক বিপুল বিশ্বাস জানান, সিঙ্গাপুরে কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি দিলেও ক্যানসার দূর হয়নি। চিকিৎসকরা হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাই অ্যান্ড্রু কিশোরের ইচ্ছায় তাকে দেশে আনা হয়। এরপর থেকে বোনের বাসায় ছিলেন। এটি ক্লিনিকও। সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
প্যাট্রিক বিপুল বিশ্বাস জানান, অ্যান্ড্রু কিশোরের দুই ছেলে মেয়ে অষ্ট্রেলিয়াতে রয়েছে। তাদের আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে। এজন্য সোমবার রাতেই তার মরদেহ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়।
দেশের গানের কিংবদন্তি পুরুষ কিশোর। তার মৃত্যুতে সঙ্গীতাঙ্গন তথা দেশের শোবিজে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। অনেকেই প্রিয় শিল্পীর মৃত্যুর খবর পেয়ে তাকে শেষবারের দেখতে ছুটে যাচ্ছেন। তবে করোনা পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে সবাইকে সচেতন থাকতে অনুরোধ জানিয়েছে অ্যান্ড্রু কিশোরের পরিবার।
অ্যান্ড্রু কিশোরের জন্ম রাজশাহীতে। এখানেই কেটেছে তাঁর শৈশব ও কৈশোর। অ্যান্ড্রু কিশোর প্রাথমিকভাবে সংগীতের পাঠ শুরু করেন রাজশাহীতেই। একসময় গানের নেশায় রাজধানীতে ছুটে যান। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, আধুনিক গান, লোকগান ও দেশাত্মবোধক গানে রেডিওর তালিকাভূক্ত শিল্পী হন।
অ্যান্ড্রু কিশোর ১৯৭৭ সালে ‘মেইল ট্রেন’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে প্লেব্যাকে যাত্রা শুরু করেন। এরপর আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। ‘
রোববার রাতেই এন্ড্রু কিশোরের সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা জানিয়ে ফেসবুক পেইজে পোস্ট দেন স্ত্রী লিপিকা অ্যান্ড্রু। প্রাণ খুলে দোয়া চেয়েছিলেন সবার কাছে। ওই পোস্টে তিনি এন্ড্রু কিশোরের চিকিৎসা থেকে শুরু করে যাবতীয় বিষয় লিখেছেন। আবেগঘন ওই পোস্টে ভাল কোন খবর ছিল না।
লিপিকা জানান, গত বছর ৯ সেপ্টেম্বর তারা সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন। সেখানে অ্যান্ড্রু কিশোরের ক্যানসার ধরা পড়ে। তারপর কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি শেষ হয় এপ্রিল মাসে। চিকিৎসক বলেছিলেন, এখন আর কিছু দরকার নাই। ওষুধ দিয়ে বলেছিলেন, আগস্ট মাসে যেতে। তারা ১৩ মে দেশে আসার জন্য টিকেট কাটেন। কিন্তু কিশোর শারীরিকভাবে খুব দুর্বল ছিলেন। তাই টিকিট বাতিল করেন। চিকিৎসক বলেন, কেমোর জন্য অ্যান্ড্রু কিশোর দুর্বল। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে, সময় লাগবে। পরে ১০ জুন তারা আবার টিকিট কাটেন। কিন্তু হঠাৎ ২ জুন কিশোরের হালকা জ্বর আসে। পরদিন রাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। তাই ৪ জুন হাসপাতালে ভর্তি করেন চিকিৎসক। কিন্তু জ্বর বার বার আসতে থাকে। কোন ওষুধ তার শরীরে কাজ করছিল না। চিকিৎসক বলেছিলেন, ক্যানসার আবারও আসছে কিনা তা দেখতে হবে। পরীক্ষার পর দেখা যায় অ্যান্ড্রু কিশোরের শরীরে সেটিই ঘটেছে।
দ্বিতীয়বার ক্যানসার ধরা পড়ায় এন্ড্রু কিশোর দেশের ফেরার সিদ্ধান্ত নেন জানিয়ে লিপিকা লেখেন, ‘কিশোর ডাক্তারকে বলে, তুমি আজই আমাকে রিলিজ করো, আমি আমার দেশে মরতে চাই, এখানে না, আমি কাল দেশে ফিরব। আমাকে বলে, আমি তো মেনে নিয়েছি, সব ঈশ্বরের ইচ্ছা, আমি তো কাঁদছি না। তুমি কাঁদছ কেন? কিশোর খুব স্বাভাবিক ছিল, মানসিকভাবে আগে থেকে প্রস্তুত ছিল। যেদিন থেকে জ্বর এসেছিল সেদিন থেকে। কিশোর হাইকমিশনে ফোন করে বলে, কালই আমার ফেরার প্লেন ঠিক করে দেন। আমি মরে গেলে আপনাদের বেশি ঝামেলা হবে, জীবিত অবস্থায় পাঠাতে সহজ হবে। ১০ জুন বিকালে হাসপাতাল থেকে ফিরি এবং ১১ জুন রাতে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দেশে ফিরে আসি আমরা। ’
তিনি লেখেন, ‘ঈশ্বরের কি খেলা, ১০ জুন আমরা সম্পূর্ণ পজিটিভ রেজাল্ট নিয়ে ফিরতে চেয়েছিলাম। অথচ ১১ জুন ফিরলাম পুরো নেগেটিভ রেজাল্ট নিয়ে। আমি ডাক্তারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম আর কতদিন? সে এটা লিখেছিল- ভবিষ্যৎবাণী করা কঠিন। তবে সাধারণত মাস থেকে বছর। এখন কিশোর কোন কথা বলে না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। আমি বলি কী ভাব, বলে কিছু না, পুরানো কথা মনে পড়ে। আর ঈশ্বরকে বলি আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাও, বেশি কষ্ট দিও না’।
এ ব্যাপারে এটা শেষ পোস্ট উল্লেখ করেছিলেন লিপিকা। লেখেন, ‘এটাই শেষ পোস্ট, এর পর আর কিছু বলা বা লেখার মত আমার মানসিক অবস্থা থাকবে না। এখনও মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন মনে হয়। কিশোর থাকবে না, অথচ আমি থাকব। মেনে নিতে পারছি না। এই অসময়ে সবাই সাবধানে থাকবেন। নিজের প্রতি যত্ন নিবেন, সুস্থ থাকবেন, ভাল থাকবেন। আর অ্যান্ড্রু কিশোরের প্রতি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি রাখবেন। প্রাণ খুলে দোয়া করবেন। ’