১৯৯৮ সালে মোহামেডান থেকে খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টেনেছিলেন নুরুল হক মানিক। কিন্তু ফুটবলকে ছাড়তে পারেননি। বাফুফের তৃণমূলের কোচ হিসেবে কাজ করেছেন। আর প্রিয় সোনালী অতীত ক্লাবের ছোট আঙিনায় বল নিয়ে ছোটাছুটি ছিল তার নিত্যদিনের অভ্যাস। ছিপছিপে গড়ন, তাই এই বয়সেও সাবেক ফুটবলারদের যে কোনো টুর্নামেন্টে পায়ের কারিকুরিতে নজর কাড়তেন এই সাবেক মিডফিল্ডার। পরিশ্রমী সেই মানুষটিকেই হার মানতে হলো মারণঘাতী করোনাভাইরাসের কাছে। গতকাল আনুমানিক সাড়ে তিনটায় সবাই কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন জাতীয় দলের সাবেক এই ফুটবলার। তার বয়স হয়েছিল ৫৫। রেখে গেছেন স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়েসহ বহু গুণগ্রাহী।
মৃত্যু সংবাদ পেয়ে করোনার আশঙ্কার মধ্যেও মানিকের কলাবাগানের বাসায় ছুটে গেছেন সাবেক ফুটবলার ও কোচ রেজাউল হক জামাল। তিনি জানালেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরেই জ¦রে ভুগছিলেন তিনি। শুক্রবার করোনার পরীক্ষা করিয়ে ছিলেন। মৃত্যুর কিছুক্ষণ পর জানা গেছে পজিটিভ এসেছে।’ মৃত্যুর ঘণ্টাখানেক আগে সাবেক ফুটবলার ও সোনালী অতীত ক্লাবের কোষাধ্যক্ষ ইকবাল গাফফারকে ফোন করে নিজেই শরীর খারাপের কথা জানান মানিক। জামাল জানিয়েছেন, ‘শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তাকে গ্রিন লাইফ, আনোয়ার খান মডার্ন, স্কয়ার ও বিআরবি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো হাসপাতালেই আইসিইউ ফাঁকা পাওয়া যায়নি। এই ছোটাছুটির মধ্যেই কোনো এক সময় হয়তো শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।’
ঢাকার মাঠে মানিককে চেনা যেত অন্য রূপে। মানিকের মাথার উপরিভাগে চুল ছিল না। কিন্তু পেছনে ছিল ঝাঁকড়া চুল। দারুণ পরিশ্রমী এই মিডফিল্ডারের পাস যেমন নিঁখুত ছিল, তেমনই দলের প্রয়োজনে নিচে নেমেও খেলতেন। শীর্ষ পর্যায়ে শুরুটা ১৯৮৫ সালে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ দিয়ে। তিন মৌসুম খেলে ১৯৮৮-তে যোগ দেন ফকিরেরপুল ইয়ংমেন্স ক্লাবে। পরের বছর ব্রাদার্স ইউনিয়ন নিয়ে নেয় তাকে। সেখানে কাটিয়েছেন টানা চার বছর। সে সময় ব্রাদার্সের মিজান-মানিক জুটি ঢাকার মাঠে বেশ আলোচিত হয়েছিল। ৯৪-এ মানিক যোগ দেন প্রিয় ক্লাব মোহামেডানে। অবসর পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। সে সময় কলকাতা মোহামেডানে খেলেন তিনি। মোহামেডান, ব্রাদার্স, ফকিরেরপুলের অধিনায়কত্বও করেছেন স্বল্পভাষী এই তারকা।
জাতীয় দলে মানিকের শুরু ১৯৮৯-এ প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ দিয়ে। সবুজ দলের হয়ে অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন মানিক। ১৯৯৮ সালে খেলা ছাড়ার পর বাফুফেতে যোগ দেন কোচ হিসেবে। গত জানুয়ারিতে এএফসি ‘এ’ লাইসেন্স সার্টিফিকেটও পেয়েছিলেন। কিন্তু করোনা মানিককে নতুন নতুন ফুটবলার গড়ার সুযোগ আর দিল না।
ঢাকা ও কলকাতা মোহামেডানে মানিকের সঙ্গে খেলেছেন এ যাবৎকালে দেশের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার কায়সার হামিদ। প্রিয় সতীর্থকে এভাবে হারাতে হবে কল্পনাও করতে পারছেন না তিনি, ‘অসাধারণ একটা মানুষকে হারালাম আমরা। খেলোয়াড়ি জীবনে আবার খুব বাধ্য ছিল মানিক। ওর সবচেয়ে বড় গুণ ছিল ওকে যেই নির্দেশনা দেওয়া হতো, ও সেভাবেই খেলত। খেলা ছাড়ার পরও ও শারীরিকভাবে অনেক সুস্থ ছিল। মানিক এভাবে চলে যাবে ভাবতেও পারছি না।’ সমসাময়িক সত্যজিৎ দাস রুপু মানিকের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পরপরই তার বোনের স্বামীর করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর খবর পান। তার এক ভাইও লড়ছেন করোনার সঙ্গে, ‘এমন মৃত্যুগুলো কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। করোনা যে কত বড় ক্ষতি করে যাচ্ছে তা বলেও বোঝাতে পারব না।’
প্রিয় সতীর্থের মৃত্যু সংবাদ পেয়েও মানিককে শেষবারের মতো দেখতে যেতে পারেননি অনেক সাবেক ফুটবলার। করোনাভাইরাস অনেক বড় ক্ষত রেখে যাচ্ছে মানবজীবনে।