২৫ জন ২০২০, sayem siraj
স্বাস্থ্য সুরক্ষার নামে ইথানল-মিথানল অ্যালকোহলের সাথে ইচ্ছেমতো কাপড়ের রঙ মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে মানহীন স্যানিটাইজার ও স্যাভলন। এমনকি এসব সুরক্ষাসামগ্রী তৈরিতে আইসো প্রোপাইল অ্যালকোহল, গ্লিসারল ও হাইড্রোজেন পারক্সাইডের মিশ্রণেও নেই কোনো মাপজোক। ফলে নকল ও নিম্নমানের এসব সামগ্রী মানুষের সুরক্ষার বদলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা মানুষের চাহিদা পুঁজি করে স্যাভলন, মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস ও পিপিইসহ সুরক্ষাসামগ্রীর নামে নকল পণ্য বাজারে ছড়িয়ে দিয়েছে। আর এসব কিনে প্রতারিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। জানা গেছে, করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর থেকেই রাজধানীর পুরান ঢাকার মিটফোর্ড, বাবুবাজারের পাইকারি ওষুধ মার্কেটের বেশ কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এসব সুরক্ষাসামগ্রী তৈরি করে খুচরা বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে। এদের নেই কোনো ল্যাব ও ক্যামিস্ট। চলতি বছরের মার্চের দিকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও স্যাভলনের সঙ্কট দেখা গেলেও এখন যত্রতত্র মিলছে এসব পণ্য। তবে আসল নয়, নকল। ফুটপাথে, কেউবা ভ্যানে, কেউ কেউ ঝুড়িতে দেদার বিক্রি করছে এসব পণ্য।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব মানহীন নকল স্যানিটাইজারে করোনাভাইরাস তো ধ্বংস হবেই না, বরং এগুলোর ব্যবহারকারীরা পড়বেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। তাই এসব ভেজাল পণ্য প্রস্তুতকারক অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে বলে জানিয়েছে ওষুধ প্রশাসন। এ ছাড়া পুলিশ বলছে, ভেজালবিরোধী অভিযান অবাহত থাকবে।
বেসরকারি ফার্মে কর্মরত মেসবাহ নামে এক ব্যক্তি জানান, ফুটপাথসহ বিভিন্ন দোকান সস্তা ও নি¤œ মানের সুরক্ষাসামগ্রীতে সয়লাব। আসল ও নকল চেনা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে গরিব মানুষ রাস্তায় যা পাচ্ছে তা কিনছে। করোনার নকলসামগ্রী শুধু রাজধানী নয়, বিভাগ ও জেলা শহর থেকে গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে আমরা কতটা সুরক্ষিত থাকছি তা কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়।
ঢাকা মহানগর পুলিশ জানিয়েছে, করোনা প্রতিরোধে বিক্রি হওয়া নকল স্যাভলন, হেক্সিসল, গ্লাভস উদ্ধারে পুলিশের অভিযান শুরু হয়েছে। তারা গত শুক্রবার মিটফোর্ডে অভিযান চালিয়ে ১ হাজার ৯০০ লিটার নকল স্যাভলন ও ৫০০ লিটার হেক্সিসল উদ্ধার করেছে। ঘটনায় জড়িত সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলোÑ মহসিন, আবদুল কাদের, মো: ডালিম, আবদুল রউফ, নুরু মিয়া, রতন মিয়া ও ইসমাইল আহমেদ। তাদের বিরুদ্ধে পুরনো ঢাকার কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। গত শনিবার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত রাজধানীর বেশ কয়েকটি ওষুধের দোকান ও ফুটপাথে অভিযান চালিয়ে ৫১ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
ঢাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহনাজ হোসেন ফারিবা জানান, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের দুইজন তত্ত্বাবধায়ক ও ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) রমনা অঞ্চলের সহকারী কমিশনার শেখ মোহাম্মদ শামীমের সহায়তায় অভিযান চালানো হয়। অভিযানে রাজধানীর শাহবাগ, আজিজ সুপার মার্কেট ও তোপখানা রোড এলাকার মেসার্স শাহরীন ড্রাগস, মেসার্স মুক্তি ড্রাগ স্টোর, মেসার্স ওয়ার্ল্ড ফার্মা, মেসার্স সেবা মেডিসিন কর্নার, মেসার্স মেডিকোর্স ফার্মেসি ও মেসার্স ভূঁইয়া ফার্মেসিতে অভিযানে গিয়ে দেখা যায়, স্যাভলনের হুবহু মোড়কে সামান্য নাম পরিবর্তন করে হয়েছে নকল ও অনুমোদনহীন জীবাণুনাশক ‘স্যালভন’ বা ‘স্যাভরন’ বিক্রি করা হচ্ছে। এ ছাড়া ভাইটা কেয়ার ও গ্রিন টাচ ইন্সট্যান্ট হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ নানা মানহীন করোনা সুরক্ষাসামগ্রী বিক্রি করা হচ্ছে। এসব পণ্যের বিষয়ে তারা প্রয়োজনীয় কাগজ দেখাতে পারেনি। এ ছাড়াও ওইসব এলাকার ফুটপাথের দোকানগুলোতেও এমন দৃশ্য দেখা যায়। তাই আট মামলায় ৫১ হাজার টাকা জরিমানা করাসহ তাদের সাবধান করা হয়।
সাধারণ নাগরিকদের এসব কেনার ক্ষেত্রে সচেতন হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে মাহনাজ হোসেন ফারিবা জানান, এসব ব্যবহারের ফলে সুরক্ষার পরিবর্তে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। তাই কেনার আগে স্যানিটাইজার দেখে নিন। বোতল বা টিউবের গায়ে এমএফজি লাইসেন্স, এমএ নং পরীক্ষা করে কিনুন।
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম সাংবাদিকদের জানান, করোনার সুরক্ষামূলক সামগ্রীগুলো নকল হলে পরিণতি হবে ভয়াবহ। একজন ক্রেতা বিশ্বাস করে এসব পণ্য ব্যবহার করছেন; কিন্তু পণ্য নকল হওয়ায় তাকে ভাইরাস থেকে কোনো সুরক্ষাই দেবে না। এসব সামগ্রী কেনার আগে আসল-নকল দেখে নিতে হবে, সচেতন হতে হবে।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব প্রফেসর ডা: এম এম আজিজ সাংবাদিকদের বলেন, নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজার, গ্লাভস ও মাস্কসহ সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহারে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীসহ সবার করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। নকল পিপিই ও মাস্কের কারণে চিকিৎসকরা করোনায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। নকল মাস্ক ব্যবহারে সুরক্ষার বদলে ফুসফুসের ক্ষতি হতে পারে। আবার নকল স্যাভলন ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারে ত্বকের পাশাপাশি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি হতে পারে।
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদন এবং বিক্রি করে যারা মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতোমধ্যে আমাদের সব ইউনিটকে নির্দেশনা দিয়েছি। দেশের কিছু জায়গা থেকে উৎপাদক ও বিক্রেতাদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
বাংলাদেশ সার্জিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি আতিকুর রহমান জানান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করতে ৭০ শতাংশ আলকোহল এবং ৩০ শতাংশ ডিসট্রিল ওয়াটার দিতে হয়। কিন্তু ফুটপাতে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের নামে যে সুরক্ষাসামগ্রী বিক্রি করা হয়, তা নিয়ম মেনে বানানো হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রঙ পানির সাথে স্প্রিট মিশিয়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বলে বিক্রি করা হয়। এতে স্বাস্থ্য সুরক্ষার চেয়ে ঝুঁকিই বাড়ছে। তিনি আরো বলেন, এসব অসাধু ব্যবসায়ীর ব্যাপারে পুরনো ঢাকার তিনটি থানায় অভিযোগ জানানো হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত থানার পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলে ফুটপাথসহ কিছু দোকানেও এ সব নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিক্রি করা হচ্ছে। এ ছাড়া নকল মাস্কেও বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, এসব নকল ও ভেজাল হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও স্যাভলন শরীরের ত্বকের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি। এ ছাড়া এগুলো করোনা প্রতিরোধে কোনো ভূমিকাই রাখে না। কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করে মুনাফা বৃদ্ধির আশায় এসব নকল ও ভেজাল পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। এসব পণ্য সরবরাহকারীরা ফার্মেসিতে পণ্য দিয়ে বলে বিক্রি করে টাকা দিয়েন। এ ছাড়া অনেকে বিদেশী পণ্য বলে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ভেজাল পণ্য বিক্রি করছে